ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ'৭১

SPEECH OF BANGABANDHU ON HISTORICAL 7TH MARCH,1971 (IN BENGALI)
বঙ্গবন্ধুর  মার্চের ভাষণ
আজ  দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি-আজ ঢাকাচট্টগ্রাম, রংপুরও যশোরের  রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে

আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এ বংআওয়ামী  লীগকে ভোট দিয়ে জয় যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবো  এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের  রক্ত দিয়ে রাজপথ  রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমুর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্ত দানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস


১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয় লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালেদেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো।১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বলেলেনতিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন,শাসনতন্ত্র দেবেন,আমরা মেনে নিলাম তারপরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সংগে আলোচনা হলো আমরা  তাকে ১৫ইং ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম।কিন্তু'মেজরিটি' পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেননা। শুনলেন সংখ্যালঘুদলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই, সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন, মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন। আমি বললাম,তবুওআমরাজাতীয়পরিষদেরঅধিবেশনেযাবএবংসংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়াসত্বেওকেউযদি ন্যায্য কথাবলে আমরা তা মেনে নেব, এমন কি  তিনি যদি একজন ওহন জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা হলো। ভুট্টো সাহেববলে গেছেন আলোচনার দরজা বন্ধনয়; আরো আলোচনা হবে। মওলানা নুরানী ওমুফতি মাহুমুদসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারী নেতা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হলো-উদ্দেশ্য ছিলো আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ৬-দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ
কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে' ডবল জিম্মী' হতে পারবেন না।পরিষদ কসাই খানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে,পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে,তাদের মাথা ভেঙে দেয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবেনাতা সত্বেও পয়ত্রিশজন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্তপয়লা মার্চ ইয়াহিয়াখান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলো, বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকেবলা হলো আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি
এরপর বাংলার মানুষপ্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো।আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলোকিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে,আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার  নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলী আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসন ভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ই মার্চ তারিখে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তাঁর সাথে টেলিফোন আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেণ্ট, ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরীব জনসাধারণকে কিভাবে হত্যাকরা হয়েছেআমার মায়ের কোলখালি করা হয়েছে 
আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোল টেবিল বৈঠক হবেনা। কিসের গোল টেবিল বৈঠক? কার গোল টেবিল বৈঠকযারা আমারমা বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে  বসবো আমি গোল টেবিল বৈঠকে ?
তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহবান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত,খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন
হঠা আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা  না করে একজনের সঙ্গে পাঁচঘণ্টা  বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমারও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো-কিন্তু গুলীকরে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলী খাইদোষ আমাদের- আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের
ইয়াহিয়া সাহেবঅধিবেশনডেকেছেন।কিন্তআমারদাবী সামরিকআইনপ্রত্যাহারকরতেহবে,সেনাবাহিনীকেব্যারাকেফিরিয়েনিতে হবে,হত্যারতদন্ত করতে হবে।তারপরবিবেচনা করেদেখবোপরিষদেবসবো কিবসনোনা।  দাবীমানারআগেপরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠেনাজনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি,শহীদদের রক্তমাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাবনা
ভাইয়েরা,  আমার  উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকেনিতে পারেনি, ফাঁসীর কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলে ছিলাম, রক্তের ঋণ  আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবোমনে আছে? আজো আমি  রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত
আমি বলে দিতে চাই,আজ থেকে কোর্ট-কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, অফিস,আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ
গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবেট্রেন চলবে আর সব চলবে ট্রেনচলবেতবে সেনাবাহিনী আনা-নেয়া করা যাবে না। করলে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবোনা সেক্রেটারীয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্টজ জকোর্টসহ সরকারী, আধা সরকারী এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ববাংলার আদান প্রদানের ব্যাঙ্কগুলো দুঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ববাংলা থেকেপশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবেন না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন বাংলাদেশেরমধ্যে চালু থাকবে। তবে, সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন এদেশের মানুষকে খতমকরা হচ্ছে,বুঝে শুনেচলবেন। দরকারহলেসমস্তচাকা বন্ধ করে দেয়া হবে
আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। 
যদি একটিও  গুলী চলে তাহলে বাংলার  ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।  রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিতে হবে।আমরা তাদের ভাতে মারবো পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদিনা থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবেনা।  গুলী চালালে  আর ভাল হবেনা। সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবানা। বাঙ্গালী মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতেপারবেনা শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামীলীগ সাহায্যে কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন সাতদিনের হরতালে যে সবশ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি শিল্প মালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন সরকারী কর্মচারীদের বলি,আমি যা বলি তামানতেহবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন,আন্দোলন কিভাবে করতে হয় আমি জানিকিন্তু হুঁশিয়ারএকটা কথা মনে রাখবেন,আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্ম কলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাইতাদের রক্ষাকরার দায়িত্ব আমাদের রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচারনা করে তবে কোন বাঙ্গালী রেডিও এবং  টেলিভিশনে যাবেননা শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাইহিসাবে বাসকরার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেননা, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে প্রস্তুত  থাকবেনঠাণ্ডা হলে চলবেনা। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন  ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃংখলা বজায়  রাখুন। শৃংখলা  ছাড়া কোন  জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না
আমার  অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে,মহল্লায়,ইউনিয়নে,আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো  ইনশাল্লাহ
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শৃংখলা বজায় রাখুন।শৃংখলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না
আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে,মহল্লায়,ইউনিয়নে,আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছিরক্ত আরও দেবো।এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ
এবারের সংগ্রাম,মুক্তিরসংগ্রাম,এবারেরসংগ্রাম,স্বাধীনতারসংগ্রাম জয় বাংলা


No comments:

Post a Comment

thanks for your valuable comments.